July 14, 2025, 6:53 pm
এম এ আলিম রিপন,সুজানগরঃ কয়েক বছর আগেও ভোরের আলো ফুটতেই তঁাতের খট খট শব্দে মুখরিত হতো পাবনার সুজানগর উপজেলার কুড়িপাড়া দুলাই, সাগরকান্দি, গোয়ারিয়া, কঁাচুরী, আহম্মদপুর, ভাটপাড়া, নিশ্চিন্তপুর, চলনা, গোপালপুর, ঘোড়াদহ, মানিকদীর, রাধানগরসহ উপজেলার অন্যান্য এলাকার তঁাতপল্লিগুলো। কিন্তু দফায় দফায় তঁাত কাপড়ের কঁাচামালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ তুলতে পারছে না প্রান্তিক তঁাতীরা। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অব্যাহত লোকসানে দুর্দিন নেমে এসেছে উপজেলার তঁাতিদের। টিকতে না পেরে অনেকে ছেড়েছেন এই পেশা। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানে পড়েছেন তারা। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তঁাতের কাজ। অনেকেই এ পেশা ছেড়েছেন। আবার বাপ-দাদার পেশা বলে অনেকেই এটি আগলে ধরে আছেন। সুতা-রঙসহ আনুষাঙ্গিক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ও আধুনিক পোশাক কারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দঁাড়িয়েছে তাদের । তঁাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিবারগুলো বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সুজানগর উপজেলা পাওয়ারলুম মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রোকন জানান, দেশের অন্যতম বৃহত্তম তঁাত সমৃদ্ধ এলাকা এই সুজানগর উপজেলার ৭ হাজার ২০০ তঁাতের মধ্যে কঁাচামালের দাম বাড়ার কারণে এরইমধ্যে প্রায় অর্ধেক তঁাতই বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাকি তঁাতগুলো যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। উপজেলার তঁাতসমৃদ্ধ এলাকা কুড়িপাড়ায় ৩ হাজার তঁাতের মধ্যে এখন মাত্র দেড় থেকে ২ হাজারের মতো তঁাত চলছে। অধিকাংশ প্রান্তিক তঁাতি ইতোমধ্যে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। বড় ব্যবসায়ীরা অর্ধেকের বেশি তঁাত বন্ধ রেখে কোনোরকম তাদের কারখানা চালু রেখেছেন বলেও জানান তিনি।
উপজেলার মেসার্স মোল্লা কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মো.ফজলুল হক মোল্লা বলেন, সুতা, রঙ, কেমিক্যালসহ তঁাতবস্ত্র উৎপাদনের সব উপকরণের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যয় যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সে অনুযায়ী উৎপাদিত কাপড়ের মূল্য বৃদ্ধি পায়নি। সেই সাথে বেড়েছে ব্যাংক লোনের সুদহার।
কথা হয় কুড়িপাড়া গ্রামের আবু হানিফ সরকারের সাথে তিনি বলেন, এটা আমার বাপ-দাদার পেশা। ছাড়তে না পারলেও লোকসান ঠিকই গুনতে হচ্ছে। আমাদের দিকে সরকারের সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
আহম্মদপুরের নারী তঁাত শ্রমিক আলেয়া খাতুন বলেন, আমাদের মজুরি কম, কোন বোনাসও নেই। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তঁাতের কাজ করি। তবে তঁাত পণ্যের এখন দাম কম হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে আমরা ভালো নেই।
তঁাত মালিক আফজাল হোসেন সরকার জানান, কারখানা চালিয়ে তাকে তিন দফায় লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। চড়া দামে সুতা ও রং কিনে কাপড় তৈরি করে লোকসান দিয়ে বাজারে বিক্রি করতে হয়েছে। একইসঙ্গে লোনের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। সে কারণে কারখানা বিক্রি করে লোন পরিশোধের পাশাপাশি নতুন ব্যবসার চেষ্টা করতে করছি।
মানিকদীর গ্রামের হাবিবুল্লাহ জানান, বর্তমানে প্রতি পাউন্ড ৮০ কাউন্ট সুতা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। অথচ কয়েক মাস আগে এই সুতার দাম ছিল মাত্র ১৭০ থেকে ১৯০ টাকা। সুতার দামের পাশাপাশি রংয়ের দাম বেড়েছে প্রায় দিগুণ। ২০০০ টাকার ইন্ডিয়ান রং এখন ৫ হাজার টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। ৬০০ টাকার মাকু এখন ২ হাজার টাকা এবং ৭০০ টাকার সানা এখন ১৫০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ সময় তিনি আরো বলেন মাত্রাতিরিক্ত দামে সুতা, রং কিনে কাপড় তৈরি করতে বাজার মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তঁাতিরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর রাশেদুজ্জামান রাশেদ জানান, তঁাত শিল্প আমাদের একটা অন্যতম ঐতিহ্য। উপজেলার অনেক তঁাত শিল্পী রয়েছে যারা খুব সুন্দর পণ্য তৈরি করছে। এ তঁাত শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সমস্যাসমূহ সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করবেন বলে জানান তিনি।
এম এ আলিম রিপন
সুজানগর(পাবনা)প্রতিনিধি।।